হিজাব পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে হয়রানি করার অভিযোগ ওঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
মৌখিক পরিক্ষায় নিকাব ও হিজাব পড়ে যাওয়ায় একজনকে জোরপূর্বক নিকাব খুলে ভাইবা নেয়া ও আরেকজনকে ভাইবা দিতে দেয়নি শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান বলে জানায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা।
এছাড়াও হিজাব বা নিকাব পড়া অবস্থায় ক্লাসে অ্যালাউ না করা ও সেকশন পরিবর্তন করতে বলার অভিযোগ ওঠেছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। গত ৩১ জুলাই (সোমবার) শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থীদের তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় এ ঘটনা ঘটে।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের নিকাব পড়ার কারণে ক্লাস চলাকালে হেনস্তা করা, নিকাব পড়া থাকলে ভাইবা নিবে না বলা ও ধর্মকে নিজেদের মতো করে বিশ্লেষণ করার অভিযোগ ওঠেছে একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও অধ্যাপক মোহাম্মদ নুরে আলম সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে।
পরিচয় শনাক্তকরণের বিকল্প হিসেবে ফিমেল টিচার থাকা সত্ত্বেও এমন কাজ শিক্ষকরা ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করে করে থাকেন বলে অভিযোগ জানায় শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাইবা দিতে না পারা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, যারা হিজাব পড়ে তাদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে হিজাব খুলে কান দেখেন নিকাব পড়ার কারণে ভাইবা বোর্ডে আমাকে বিভিন্নভাবে কথায় জর্জরিত করে বোঝাচ্ছিল যাতে করে আমি নিকাব খুলি। নয়তো তারা আমার পরীক্ষা নিবে না। শেষ পর্যন্ত আমার পরীক্ষা নেয়নি।
শিক্ষার্থী আরও বলেন, এছাড়াও অনেকসময় ক্লাস রুমে নিকাব পড়ার কারণে হেনস্তার শিকার হতে হয়। এখানে নির্দিষ্ট করে কিছু শিক্ষক এমন কাজ করে থাকেন। অনেকসময় তারা নিকাব পড়ার কারণে বলে ‘ধর্মের দায়িত্ব পালন করতেছো কিন্তু এটাতো ধর্ম না’। ওনারা ধর্মকে নিজেদের মতো করে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। এছাড়াও ভাইবা বোর্ডে নিকাব পড়া থাকলে পরীক্ষা নিবে না বলে হেনস্তা করেন।
জোরপূর্বক ভাইবা দেয়া শিক্ষার্থী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ভাইবা বোর্ডে সভাপতি ছিলেন ওয়াহিদুজ্জামান স্যার। আমি যাওয়ার পূর্বেও যারা হিজাব পড়ে গিয়েছে তিনি তাদের হিজাব খুলে কান চেক করেছেন। আমি ঢুকার সাথে সাথে তিনি বলেন নিকাব পড়া থাকলে আমার ভাইবা নিবেন না। তখন সেখানে একজন ফিমেল টিচার ছিলেন, আমি ওনার সাথে কথা বলি যে যদি আমাকে আইডেন্টিফাই করার প্রয়োজন হয় তাহলেতো ফিমেল টিচার আছেন। এটাতো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না।
এরপরে ওনি আমাকে বলেন, ‘এটা কোনোভাবে সম্ভব না। স্যার ভাইবা বোর্ডের সভাপতি তোমাকে ফেস খুলেই ভাইবা দিতে হবে নয়তো এটা কোনোভাবেই গ্রহণ করবেন না। এ প্রসঙ্গে ওয়াহিদুজ্জামান স্যার বলেন ইসলাম এতো কঠোর না এবং নিজেদের মতো করে অনেককিছুই বুঝানোর চেষ্টা করেন।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আরও বলেন, আসলে ওনারা যখন কথা বলতে থাকেন তখন আমাদেরকে কোনো কথা বলতে দেন না। ওনারা নিজেরা চেষ্টা করেন আমরা যেন নিকাব খুলতে বাধ্য হই। এটা বলার পরে আমি বের হয়ে যাই। পরে ফিমেল টিচার এসে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যেন নিকাব খুলে ভাইবা দেই। আমি ম্যামকে বলেছি ‘এটাতো আসলে সম্ভব না’।
স্যার আমাকে বলেন ‘ঠিকাছে তোমার কান খুলতে হবে না তুমি ফেস খুলে ভাইবা দেও’। ম্যাম আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন ওনি যেহেতু চেয়ারম্যান ওনার আসলে কিছু করার নেই। তোমার এভাবেই ভাইবা দেয়া উচিত। ম্যাম আমাকে বলেন আমাকে হেল্প করবেন আমি যেনো আসি। তখন আমি আসলে নার্ভাস হয়ে যাই। ম্যাম আমাকে কোনোমতে ভাইবা শেষ করে বের করে দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আমি তৃতীয় বর্ষের ভাইবা বোর্ডের প্রধান, আমার বোর্ডে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমার বোর্ডে এমন কেউ নেই যে পরীক্ষা দেয়নি। হিজাব থাকলে তার আইডেন্টিফিকেশন দরকার তাকে সেটা করতে হবে। এটা আইনেও আছে। একজন সম্ভবত অনুপস্থিত ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, গত সিমেস্টারের আগের সিমেস্টারে আমি একজন শিক্ষার্থীর ভাইবা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছি। আমাদের কারিকুলামে ভাইবাতে বিষয় জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা অর্জন হিসেবে কমিউনিকেশন স্কিলের কথা বলা আছে। ফলে শিক্ষার্থীরা বিষয় জ্ঞানের পাশাপাশি কীভাবে কনফিডেন্সের সাথে ব্যাখ্যা করে সেটিও লক্ষ্য করতে হয়, কিন্তু মুখ ঢেকে রাখলে সেটা সম্ভ হয় না। আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি আমার বোর্ডে মূল্যায়ন করতে পারবো না। হিজাব পড়া বা মুখ দেখা গেলে কোনো সমস্যা নেই তবে নিকাব পড়া থাকলে মূল্যায়নে সমতা নিশ্চিত হয়না।
তিন আরও বলেন, ক্লাসে কাউকে হিজাব বা পোশাক পড়ার কারণে অপদস্ত করেছি এটি মিথ্যা প্রচারণা। আমার ক্লাসে হিজাব বা নিকাব পড়া অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। যেহেতু তাদেরকে ওইভাবে চিনিও না ফলে তাদেরকে কোনো প্রশ্ন করা হয় না, ইন্টার্যাকশনটা কম হয়। ধর্ম ও হিজাব সম্পর্কে আমি ক্লাসে কখনোই ব্যাখ্যা করিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমার থিসিসের স্টুডেন্ট রয়েছে যারা হিজাব পড়ে। আমরা চাই ইসলামের সমাজ উন্নয়ন ও মানবাতার দিকগুলো গ্রহণ করে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করুক। কোভিডের পরে জঙ্গিবাদ সম্পর্কে নিউজ হওয়ায় আমরা ধর্মের প্রকৃত ম্যাসেজ সম্পর্কে সচেতন করি। ইসলামের পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থায় জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও কাউকে এককেন্দ্রিক করা সমর্থন করে না। হিজাব নিয়ে সমস্যা না আমার দেখার বিষয় কোনো শিক্ষার্থী যেন বিপথে চলে না যায়।
তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের রায় অনুসারে ভাইবায় একজন শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করার জন্য তার কানসহ চেহারা দেখতে হয়। সেখানে বাবা-মায়ের মতো শিক্ষকরা অনুরোধ করেন একবার চেহারা দেখানোর জন্য, কেউ যদি ধর্মের কথা বলে এটা না করতে চায় তাহলে সে মৌলবাদকে সমর্থন করলো।
নিকাব পড়া শিক্ষার্থীর মহিলা শিক্ষকের নিকট চেহারা দেখাতে চাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি কেউ মহিলা শিক্ষকের কাছে চেহারা দেখাতে চায় আমরা তাকে স্বাগত জানাবো।
কে