নিখুঁত ইমান ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত বিষয়ে কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী যথাযথ বিশ্বাস পোষণ না করলে ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর কাছে গৃহীত হয় না। অন্যদিকে ইবাদত-বন্দেগিকে সুরক্ষিত করে পরকালীন জীবনে প্রতিদান লাভের উপযোগী করার জন্য লেনদেনে স্বচ্ছতা অপরিহার্য। এই লেখায় লেনদেনে স্বচ্ছতার গুরুত্ব প্রাসঙ্গিক আলোচনাসহ তুলে ধরা হলো—
লেনদেনে স্বচ্ছতার গুরুত্ব
পার্থিব জীবনের অতিপ্রয়োজনীয় একটি বিষয় হলো আর্থিক লেনদেন। লেনদেনের আরবি প্রতিশব্দ মুআমালাত। ইসলামে মুআমালাত তথা লেনদেনের গুরুত্ব অনেক বেশি। মহানবী (সা.)-এর জীবন ছিল পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও সংরক্ষিত। লেনদেনের ক্ষেত্রে পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতা তাঁকে ইসলামপূর্ব যুগে ‘আল-আমিন’ বা ‘বিশ্বস্ত’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
এ বিষয়ে কিয়ামতের ময়দানে দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া কাউকে এক ধাপও সামনে যেতে দেওয়া হবে না। জিজ্ঞাসা করা হবে—‘কীভাবে উপার্জন করেছ এবং কোথায় খরচ করেছ?’ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি বিষয়ে জবাব না দেওয়া পর্যন্ত কোনো মানবসন্তানের পা ওঠাতে দেওয়া হবে না। এক. জীবন কীভাবে শেষ করেছ। দুই. যৌবন কীভাবে বিদায় করেছ। তিন. ধনসম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছ। চার. কোন পথে তা ব্যয় করেছ। পাঁচ. অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছ।’ (তিরমিজি: ২৪১৬)
অস্বচ্ছতা দোয়া কবুলের অন্তরায়
লেনদেনে অসততা ও অস্বচ্ছতার কারণে দোয়া ও ইবাদত কবুল হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) একজন লোকের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—সে দীর্ঘ পথ সফর করে এসেছে। চুলগুলো এলোমেলো ও শরীর ধুলোয় ধূসরিত। আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া করছে—হে আমার রব, হে আমার রব। অথচ তার খাদ্য-পানীয় হারাম, পোশাকপরিচ্ছদ হারাম; তাহলে কীভাবে তার দোয়া কবুল হবে?’ (মুসলিম: ১০১৫)
একইভাবে অবৈধ উপার্জনকারীর ইবাদতও কবুল হয় না। হাদিসে এসেছে, ‘অজু ছাড়া নামাজ কবুল হয় না আর আত্মসাৎ করা সম্পদের সদকাও কবুল হয় না।’ (মুসলিম: ২২৪)
অস্বচ্ছ ও হারাম সম্পদ দ্বারা গড়ে ওঠা শরীর জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এমন শরীর কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম সম্পদ দ্বারা বর্ধিত। জাহান্নামই তার উপযুক্ত স্থান’ (আহমাদ: ১৪৪৪১)
অস্বচ্ছতা ইবাদত নষ্ট করে
আর্থিক অস্বচ্ছতা ইবাদত-বন্দেগিতে প্রভাব ফেলে। পরকালীন জীবনে ইবাদতকে মূল্যহীন ও অন্তঃসারশূন্য করে তোলে। অর্থবিত্তসহ লেনদেনের সামগ্রিক অস্বচ্ছতা প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কি জানো, দরিদ্র কে?’ সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘আমাদের মধ্যে দরিদ্র ওই ব্যক্তি, যার কোনো অর্থ ও সম্পদ নেই।’ তিনি (রাসুল) বললেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে দরিদ্র ওই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা, জাকাত নিয়ে আসবে। সে আরও নিয়ে আসবে—অন্যকে এই পরিমাণ গালি দিয়েছে, এই পরিমাণ মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, এই পরিমাণ সম্পদ খেয়েছে, এই পরিমাণ রক্ত প্রবাহিত করেছে, অন্যকে এই পরিমাণ প্রহার করেছে। তার নেকি থেকে সেই পরিমাণ (ক্ষতিগ্রস্তকে) প্রদান করা হবে। তার দায় শেষ হওয়ার আগেই যদি তার নেকি শেষ হয়ে যায়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্তদের পাপ পাওনা অনুসারে ওই ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে। ফলে সে এই পাপের বোঝা নিয়ে জাহান্নামে যাবে।’ (মুসলিম: ২৫৮১)
অসততার পথ খোলে যেভাবে
বিভিন্নভাবে আর্থিক স্বচ্ছতা নষ্ট হয়। যেমন অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা, জোরপূর্বক অন্যের সম্পদ দখল করা, এতিমের মাল ভক্ষণ করা, ঋণ পরিশোধ না করা, অন্যের প্রাপ্ত অধিকার প্রদান না করা, চুরি বা সন্ত্রাসী করে অন্যের সম্পদ ভোগ করা ইত্যাদি। কোনো প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব ঠিক না রাখা, খাতওয়ারি অর্থ খরচ না করা এবং নিয়ম অনুযায়ী ব্যয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করাও আর্থিক অসততার অন্তর্ভুক্ত। সর্বোপরি যেকোনো পদ্ধতিতে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে নিজের দখলে নেওয়াই আর্থিক অসততা।
আর্থিক অসততা থেকে বেঁচে থাকতে কোরআন-সুন্নাহতে বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।’(সুরা বাকারা: ১৮৮)
আবু হুররাহ আর-রক্কাশি (রহ.) তাঁর চাচা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবধান! কারও ওপর জুলুম করবে না। সাবধান, কারও মাল তার মনোতুষ্টি ছাড়া কারও জন্য হালাল হবে না।’ (মিশকাত: ২৯৪৬)
পরিশেষে বলা যায়, আল্লাহ মানুষকে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল করে সৃষ্টি করেছেন। কোনো মানুষের পক্ষে জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। এ জন্য পরস্পরের সঙ্গে লেনদেন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সততা ও পরিচ্ছন্নতা জরুরি। স্বচ্ছতা না থাকলে নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতের মতো ইবাদত-বন্দেগিও কোনো কাজে আসে না। কাজেই আর্থিক স্বচ্ছতাই ইবাদতের রক্ষাকবচ।